টানা এক মাসের তুমুল উত্তেজনার বিশ্বকাপ ফুটবল শেষ হয়েছে রবিবার রাতে ফ্রান্সের শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে। লড়াকু মেজাজে ফাইনালে আসা ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্ন ভেঙে গেছে। বিশ্বের ফুটবলপাগল মানুষের আনন্দেই নয়, বাংলাদেশের ফুটবল দর্শকদের রুটিনেও ছন্দপতন ঘটেছে। বাংলাদেশের মানুষ নিজের দেশকে বিশ্বকাপ আসরে দেখতে পায় না বলে বুকের গহিনে গভীর ক্রন্দন লুকিয়ে রাখে। বিশ্বকাপ এলেই তুমুল উত্তেজনা নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। মহাধুমধামে তীব্র আকর্ষণ নিয়ে রাত জেগে ফুটবল দেখে। পরিবার-পরিজন, নারী-শিশু ও বৃদ্ধরা ঘরে ঘরে টিভির সামনে বসে প্রতিটি খেলা উপভোগ করেন। অনেকে নিজের দলের জার্সি গায়ে খেলা দেখেন।
সাদাকালো টেলিভিশনের যুগ থেকেই বিশ্বকাপ ফুটবলের টিভি দর্শক এ দেশের মানুষ। তখন সবার ঘরে ঘরে আজকের মতো এত এত রঙিন টেলিভিশন ছিল না। যেখানেই সাদাকালো টিভি, সেখানেই লম্বা বাঁশের মাথায় অ্যান্টেনা লাগিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল আসরে দর্শকরা টিভি দেখতেন। একালের রঙিন টেলিভিশন ছাড়াও নানা জায়গায় বড় পর্দায় দলবেঁধে মানুষ ফুটবল খেলা দেখেছেন।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হয় আর্জেন্টিনা না হয় ব্রাজিলের সমর্থক। সেই ম্যারাডোনার ১৯৮৬-এর বিশ্বকাপ জয়ের সময় আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়েছিলাম। সেই থেকে এখনো আছি। এ দেশে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের বাইরে অনেকেই ফ্রান্স, জার্মানি বা ইতালির সমর্থক রয়েছেন। এবারের বিশ্বকাপে ইতালি ছিল না। প্রথমে আর্জেন্টিনা তারপর ব্রাজিলও বিদায় নিয়েছে।
এবারের আসরে সেই ম্যারাডোনার মতো কিংবদন্তি ফুটবলার ছিলেন না। প্লাতেনি, জিদান, সক্রেটিস, জিকো, বেকহ্যামের মতো ফুটবল মাঠ আলো করা তারকাও ছিলেন না। তবু বিশ্বকাপ আসর আলোকিত করেছিলেন আর্জেন্টিনার মেসি, ব্রাজিলের নেইমার, পর্তুগালের রোনালদো, ফ্রান্সের এমবাপ্পে, ইংল্যান্ডের হ্যারি কেন ও ক্রোয়েশিয়ার মডরিচ। তারা দর্শকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নিয়েছিলেন। আর্জেন্টিনার দর্শকরা এক যুগ ধরে মেসিকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্নেরও মৃত্যু ঘটেছে। ব্রাজিলের ছন্দময় ও গতিময় ফুটবল সেমিফাইনালেই যেতে পারেনি। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবল থেকে ছিটকে পড়ার পর ভাঙা হৃদয় নিয়ে ফাইনালে সংখ্যাগরিষ্ঠ দর্শক ক্রোয়েশিয়াকে সমর্থন দিয়েছিলেন। জয়ের জন্য তাদের লড়াকু মেজাজ ফুটবল বিশ্বে সুপার পাওয়ার শক্তিকে পরাভূত করে শিরোপা লড়াইয়ে নতুন শক্তির আবির্ভাবকে ফুটবল দর্শকরা স্বাগত জানিয়েছিলেন।
ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট অনিন্দ্যসুন্দরী স্বর্ণকেশী কালিন্দা গ্রেভারের রূপে মুগ্ধ হয়েই ফুটবলপ্রেমিক দর্শকরা ক্রোয়েশিয়াকে সমর্থন দেননি। ফুটবল ও তাঁর দেশের খেলোয়াড়দের যেভাবে প্রেরণা দিয়েছেন, জার্সি পরে সস্নেহে ফুটবলারদের উষ্ণ আলিঙ্গন দিয়েছেন, বিজয় উল্লাসে তাদের সঙ্গে নেচে উঠেছেন, সেই প্রেমের শক্তিকেই ফুটবলপ্রেমিক মানুষ অভিবাদন জানিয়েছে।
একালের তথাকথিত অর্ধশিক্ষিত মুখরা নারীবাদীদের কেউ কেউ যদিও মনে করেছেন, কারও কারও প্রচার করা বিকিনি পরা আমেরিকান নারী মডেলের খোলা শরীরের দেহ গঠনের চাকচিক্যে প্রলুব্ধ হয়ে সমর্থন দিয়েছেন। তারা ভুল করছেন। দর্শকরা যখন দেখেছেন তাদের হট ফেবারিট আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল দল তুমুল উত্তেজনার বিশ্বকাপের ফাইনালে নেই, তখন তারা মনে করেছেন, আমাদের প্রিয় দল যখন শিরোপার চূড়ান্ত লড়াইয়ে যেতে পারেনি, তখন আর কেউ নয়, ক্রোয়েশিয়াই শিরোপা জিতে নিক। বিষয়টি ছিল এ রকম খানিকটা, আমিও খাব না, তুইও খাবি না, ক্রোয়েশিয়াই খাক। সেই সঙ্গে তাদের ফুটবল লড়াই ও ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্টের ফুটবল অনুরাগী মন ও তাঁর সৌন্দর্য দর্শকদের টেনেছে এটাও সত্য। সুন্দরের পূজারি হওয়া অপরাধ নয়। প্রেমিক হওয়া নিন্দার নয়। যৌন বিকৃত রুচি আর ধর্ষক চরিত্রই লজ্জা আর ঘৃণার। অপরাধের। এ লেখা যখন লিখছি তখন, সিলেট ওসমানী হাসপাতালে একজন ইন্টার্নি ডাক্তার মাকাম মাহীর হাতে রোগীর অ্যাটেনডেন্ট নাতনি ধর্ষিত হয়েছে। ধর্ষক ডাক্তার গ্রেফতার হয়েছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতাধর একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ সংসদে ‘চুমু মতিন’ খেতাব পেয়েছিলেন। আমার জানা রিজভি নামের এক নিউরোলজিস্টের কাছে বিশ্বাস নিয়ে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পত্নী গেলে তিনি যৌন বিকারে আগ্রাসী হয়ে অপমাণিত হয়েছেন। রোগী যখন ডাক্তারের কাছে নিরাপদ নয়, রোগীর স্বজন যখন নিরাপদ নয়, শিক্ষকের কাছে লুট হয় ছাত্রীর সম্ভ্রম তখন প্রশ্ন জাগে এই নষ্ট সমাজ কোথায় যাচ্ছে? বিভিন্ন পেশায় কিছু কিছু বসের কাছে একালেও কেন নারী সহকর্মী নিরাপদ নয়? বিভিন্ন পেশায় কেন নারী সহকর্মীকে ঘিরে একদল বিকৃত পুরুষের মনোরঞ্জন?
যাক, দ্বিতীয় দফা চ্যাম্পিয়ন হওয়া ফ্রান্সের হাতে শিরোপা তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুষলধারে নেমে আসা বৃষ্টিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ও ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কালিন্দা এক ছাতার নিচে ঠাঁই নিলেন। ফুটবল যে মানুষকে একাত্ম করে তাই নয়, দুই রাষ্ট্রনায়ককেও উষ্ণ সান্নিধ্যে পৌঁছে দেয়। বিশ্বের কোটি কোটি দর্শক বিশ্বকাপ আসরের মিলনমেলা ভাঙার দৃশ্য বেদনাবোধ নিয়ে দেখতে গেলেও সেই সুন্দরকে উপভোগ করেছেন দুই নয়নে।
ক্রোয়েশিয়ার শিরোপা লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দুর্দান্ত খেলা ও শিরোপা জেতার ফাইনালে অপরাজিত অংশগ্রহণ আমাদের কিছুটা হলেও ঝাঁকুনি দিয়েছে। আমাদের মধ্যে এই বোধোদয়ের জন্ম দিয়েছে, ক্রোয়েশিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেললে বাংলাদেশ কেন বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশই নিতে পারে না! মাত্র সেদিন ১৯৯১ সালে ক্রোয়েশিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। ৪২ লাখ মানুষের দেশ ক্রোয়েশিয়া ১৯৯৮ বিশ্বকাপে অংশ নিয়েই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে পরাজিত করে সেমিফাইনালে চলে যায়। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের কাছে ২-১ গোলে হেরেছিল সেবারও ক্রোয়েশিয়া। আর স্বাগতিক ফ্রান্স সেবার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ে উৎসবের বন্যায় ভেসে যায়। একসময় ফিফার র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ক্রোয়েশিয়ার স্থান অনেক নিচের দিকে থাকলেও স্বাধীন ক্রোয়েশিয়া সাত বছরের মাথায় বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নিয়ে দর্শক হৃদয়ে আসন নিয়েছিল। চমক সৃষ্টি করেছিল। আর বাংলাদেশ এবার ক্রোয়েশিয়া যখন অপরাজিত দল হিসেবে তারুণ্যনির্ভর অভিজ্ঞ ফ্রান্সের কাছে পরাজিত হয়েছে, তখন আমরা বাংলাদেশ নিজেদের ফুটবলের দিকে তাকালে গভীর হতাশা ও বেদনায় নিমজ্জিত হই। আয়নায় চোখ রাখলে লজ্জা ও গ্লানিতে ডুবে যাই।
বাংলাদেশ ফুটবলের সঙ্গে যারা জড়িত সেই বাফুফের কর্মকর্তারা আদৌ লজ্জিত হন কিনা, আদৌ গ্লানিতে ডোবেন কিনা একজন ফুটবলভক্ত হিসেবে দেশের প্রতি গভীর আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে এই প্রশ্নের দহনে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের লড়াই থেকে নেমে প্রাক-বাছাই পর্ব থেকেই আউট হয়ে যায়। আমাদের ছেলেবেলা ও তারুণ্যে গোটা দেশের মানুষ ছিল ফুটবল উন্মাদনায় মাতোয়ারা। জাতীয় লিগই নয়, জেলায় জেলায় নিয়মিত ফুটবল লিগই নয়, আন্তবিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও স্কুল পর্যায়েও নিয়মিত ফুটবল লড়াইয়ের আসর বসত। গ্রামেগঞ্জে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে ফুটবল খেলা ঘিরে হাজার হাজার দর্শক উপচে পড়ত। স্টেডিয়াম ঘিরে সে কি তুমুল উত্তেজনার ফুটবল। এখনো ভাবলে শরীর ও মন রোমাঞ্চিত হয়।
আবাহনী-মোহামেডানের খেলা যেদিন হতো সারা দেশে সমর্থকরা নিজ নিজ দলের বিশাল পতাকা নিয়ে উৎসবে মেতে উঠতেন। কাজী সালাউদ্দিনের মতো ফুটবল কিংবদন্তি আবাহনীর হয়ে ফুটবল দর্শকদের হৃদয় জয় করেছিলেন।
হাওরবেষ্টিত জল-জোছনার শহর সুনামগঞ্জের বুক চিরে বইছে সুরমা নদী। সুরমার ওপার থেকে উঠে এসে ঢাকার ফুটবল মাঠ কাঁপিয়েছিলেন ছোট নজির। সালাম মুর্শেদী, বাদল রায়, শেখ আসলাম, সত্যজিৎ রায় রুপু, চুন্নু ও মুনেম মুন্না থেকে সাব্বির এমনকি আরিফ খান জয়রা প্রান্তিক থেকে উঠে এসেছিলেন জাতীয় স্টেডিয়ামে। কায়সার হামিদ, কানন, মানিকদের কথা এখনো ভোলেনি দর্শক। তারা ফুটবল জাদুতে দর্শক হৃদয় জয় করেছিলেন। তখন ফুটবলাররা এখনকার মতো এত টাকা পেতেন না। কিন্তু খেলতেন দুর্দান্ত। ফুটবলকে যেমন শিল্পের উচ্চতায় নিয়েছিলেন, তেমন দর্শকদের ফুটবল প্রেমে উন্মাদ করেছিলেন।
সেই কাজী সালাউদ্দিন ১০ বছর ধরে ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হয়ে আছেন। ফুটবল ফেডারেশনে সালাম মুর্শেদী, বাদল রায় ও আসলামরা আছেন। কিন্তু ফুটবলের সেই ক্রেজ নেই। নেই সেই ফুটবল লড়াইয়ের উন্নত মান। সম্প্রতি স্বনামধন্য কার্ডিওলজিস্ট আমাদের ভাবি ডা. জাহানারা আরজু ফেসবুক ইনবক্সে রসিকতা করে একটি ছবি পাঠিয়েছেন। যেখানে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা স্টেডিয়ামে সবজি চাষ হচ্ছে। ফুটবল লড়াইয়ে পিছিয়ে গেলেও ঢাকা স্টেডিয়াম সবজি চাষে ভালোই এগিয়েছে।
১৯৯৮ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার ডেবর সোকার গোল্ডেন বুট জিতেছিলেন। ক্রোয়েশিয়া ফুটবল ফেডারেশনে ছয় বছর ধরে তিনি প্রেসিডেন্ট। তিনি দায়িত্ব নিয়ে পাঁচ বছরব্যাপী পরিকল্পনা করে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের ফুটবল খেলার মধ্য দিয়েই বাছাই করেননি, নিজস্ব কোচ দিয়ে ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা করেন। এতে ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। যার ফলে ক্রোয়েশিয়া আজ বিশ্বকাপ শিরোপা জেতার লড়াই করেছে। অথচ ফুটবল বোদ্ধা ও বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, আর্জেন্টিনা, নাইজেরিয়া ও আইসল্যান্ড গ্রুপ থেকে যে দুটি দল প্রথম পর্বে বাদ পড়বে তার একটি হবে ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু তিন ম্যাচ জিতেই ক্রোয়েশিয়া দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠেনি, আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চমকে দিয়েছিল ফুটবল দুনিয়াকে।
আমাদের অতীত ফুটবল গৌরব ও অহংকারের। আজকের ফুটবল লজ্জা ও গ্লানির। ফুটবলের এই করুণ পরিণতির দায় কে নেবে? বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন এই দায় কি এড়িয়ে যেতে পারে? ১৯৮৮ সালেও ঢাকার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ইরানের চ্যাম্পিয়ন দলকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল। এশিয়ান কাপ ফুটবলে আটজন জাতীয় দলের খেলোয়াড ছিল ওই দলে। যে জার্মানিকে কোরিয়া হারিয়েছে এবার বিশ্বকাপে, সেই কোরিয়াকে ১৯৮৯ সালে হারিয়ে ঢাকার মাঠে আমাদের লাল দল প্রেসিডেন্ট কাপ জিতে নিয়েছিল। ওরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে পারলে আমরা কেন পারলাম না? আমাদের সরকারের অনুদান, আন্তরিকতা, স্পন্সর এমনকি ফিফার অনুদানও মিলেছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, ফুটবলের পেছনে বিনিয়োগ করা এত টাকা যায় কোথায়? বিনিয়োগ ঠিকই হয়, কিন্তু ফুটবলের মান উঠে আসে না। ফুটবলের সূর্যোদয় ঘটে না। ফুটবলের অস্তমিত সূর্য দেখতে দেখতে আমরা জানতেও পারি না, ফুটবল ফেডারেশন কেন কোনো সময়ই টাকার হিসাব দিতে পারে না। খেলার মান বাড়াতে পারে না। অনেকে মনে করেন, ফুটবলের টাকা যদি সঠিক খাতে ব্যয় হতো, তাহলে দর্শকনন্দিত এই খেলার করুণ দশা ঘটত না। আমরা বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বপ্ন দেখা দূরে থাক, বিগত তিন আসরে সাফ ফুটবলে সেমিফাইনাল খেলতে পারছি না। ভুটানের কাছেও হেরে যেতে হয়। এবারও প্রাক-বাছাই পর্বে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলে হেরেছি। আর তারা বিশ্বকাপ খেলেছে।
আমাদের নারী ফুটবলও নারী ক্রিকেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়েছে। অনূর্ধ্ব সাফ ফুটবলে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। মূল নারী ফুটবলে রানার্স-আপ হয়েছি। এশিয়ান ফুটবল বাছাই পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। গরিবের কন্যারা ফুটবলকে এগিয়ে নিতে পারলে এত টাকা ঢাললেও ছেলেরা ফুটবল নিয়ে এতটা পিছিয়ে— এই প্রশ্নের জবাব আজ মানুষের মনজুড়ে।
বিশ্বকাপের উন্মাদনায় আমাদের গৌরবের ক্রিকেট মাঝখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে হোয়াইটওয়াশ হয়ে এসেছে। অন্যদিকে ক্রিকেটেই মেয়েরা ভারতকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জয় করে নিয়েছে। অথচ ছেলেদের পেছনে যে অর্থ বিনিয়োগ হয়, মেয়েদের জন্য সেই তুলনায় না আছে বরাদ্দ, না আছে সম্মান ও পুরস্কার। আমাদের জেলায় জেলায় এখন ফুটবল লিগ নেই। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতার আসর নেই। শেরেবাংলা কাপ, সোহরাওয়ার্দী কাপ টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে আছে। এতে ফুটবলপাগলের দেশে ফুটবল হোঁচট খেয়েছে।
অন্যদিকে ফুটবল তারকা জন্ম নেওয়া দূরে থাক, ফুটবল তার গৌরবের অতীতও ফিরে পাচ্ছে না। ফুটবল ক্লাবগুলোও দায় এড়াতে পারে না। তারা চ্যাম্পিয়ন হতে চায়। কিন্তু ফুটবলার তৈরি করতে চায় না। বসুন্ধরা কিংস চ্যাম্পিয়ন হয়ে ট্যালেন্ট হান্ট শুরু করেছে। কোনো ক্লাব আগে শুরু করেনি। চ্যাম্পিয়ান লিগজয়ী বসুন্ধরা কিংসের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইমরুল হাসান এবার দলকে প্রিমিয়ার লিগ খেলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বড় করপোরেট হাউসগুলোকেও এভাবে ফুটবল দরদ নিয়ে আসতে হবে।
৪২ লাখ লোকের দেশ ক্রোয়েশিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলে শিরোপা জেতার লড়াই করলে ফুটবলের গৌরবময় ও বর্ণাঢ্য অতীতের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা ১৮ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে কেন বিশ্বকাপ খেলবে না— এই প্রশ্নের জবাব ফুটবল ফেডারেশনের কর্তাদের দেওয়ার সময় এসেছে। আমাদের এমন গরিব ফুটবলপ্রেমিকও আছেন যিনি জমি বিক্রি করে জার্মানির লম্বা পতাকা বানান। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও খেলোয়াড়দের তুমুল উৎসাহ দিতে পারেন। যে উৎসাহের কাছে ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কালিন্দার প্রেরণা ম্লান। তাহলে কেন আমরা পিছিয়ে থাকব?
বিশ্বকাপ ফুটবলের এই উন্মাদনায় গোটা বাংলাদেশ যখন ডুবে ছিল, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীর আন্দোলন ঘিরে ‘দিনে ছাত্রলীগ রাতে পুলিশ’ এই নাটকের আতঙ্ক তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়েছে। যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসমাজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-লড়াই-সংগ্রামের তীর্থস্থানই নয়, গণতন্ত্রকামী মানুষের দাবি আদায়ের উৎসভূমি বলে আমাদের গৌরবময় ইতিহাসে সমুজ্জ্বল, সেখানে কবি রফিক আজাদের কবিতার মতো ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’ পেতে দিতে হয়েছে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীকে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শান্তিনিকেতনের মতোন প্রাকৃতিক দৃষ্টিনন্দন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মতিহার ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ কর্মীরা হাতুড়িপেটা করে আন্দোলনরত তরিকুলকে পঙ্গু করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও তারা দিনেদুপুরে হামলার শিকার হয়েছে। এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকরা মানববন্ধনে নেমে এলে তারাও রেহাই পাননি।
গণতান্ত্রিক সমাজে ডাকসু একসময় ছিল সেকেন্ড পার্লামেন্ট খ্যাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে পরিচিত। সেই ডাকসু কবরে শায়িত ২৭ বছর ধরে। আর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের মন্দিরের অহমিকাই হারায়নি, গণতান্ত্রিক চেতনার জাগ্রত চারণভূমিতে ছাত্র-শিক্ষকদের ন্যায়সংগত দাবির প্রতি ইস্পাতকঠিন ঐক্য নির্বাসিত হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি গৌরবময় অতীতের ধারা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তবু গণতান্ত্রিক সমাজে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস মুক্তিযুদ্ধের অহংকারে দাঁড়ানো সব মত-পথের গণতান্ত্রিক অধিকারের চেতনাসম্পন্ন শক্তির আন্দোলন ও সংগ্রাম মতপ্রকাশের চারণভূমি হয়েই থাকতে পারে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষের শক্তি যেমন সভা-সমাবেশ করার অধিকার রাখে, বিপক্ষের শক্তিও সেই অধিকার ভোগ করতে পারে। কিন্তু হামলা, নিপীড়ন কোনো গণতান্ত্রিক শক্তির জন্যও সুখকর হতে পারে না। রাতে পুলিশ আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের আটক করছে। আদালত রিমান্ড দিচ্ছে। রাশেদের মা আর্তনাদ করছেন। তারিকুলের বাবা আহাজারি করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বিবেচনায় নিয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি কাজও শুরু করেছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যদি আদালতের নির্দেশনায় হাত দেওয়া না যায়, সরকার তবু বিবেচনা করলে পদক্ষেপ নিতে পারে। সংবিধান কোটা বাতিলের পক্ষে না থাকলেও সংস্কারের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের পূর্বসূরিদের থেকে শুরু করে উত্তরসূরিরা অল্প টাকায় লেখাপড়া করেছেন, করছেন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এই ভর্তুকি দেওয়া হয়। যদিও জনগণের টাকায় লেখাপড়া করে সমাজে ও নানা পেশায় এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে জনগণের সঙ্গেই আমরা অনেকে অতীতে প্রতারণা করেছি। বর্তমানে করছি। ভবিষ্যতেও হয় তো করব। কিন্তু জনগণের টাকায় লেখাপড়াকালেই আমাদের পূর্বসূরিরা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধিকার-স্বাধীনতার পথ ধরে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেমন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমন আমরা সামরিক শাসনের কবল থেকে গণতন্ত্রের মুক্তির লড়াই করেছি। তেমনি আমাদের উত্তরসূরিরা তাদের সাংবিধানিক অধিকারবলে গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন করছেন। সরকারও সেটিকে বিবেচনায় নিয়েছে। এ অবস্থায় দমন-পীড়ন আতঙ্কের পথ পরিহার করে সমঝোতা ও শান্তির পথ গ্রহণ করা সবার জন্য সুখকর। ব্যাংক ঋণের নামে যে টাকা লুট হয়েছে, বিদেশে বছর বছর যে টাকা পাচার হচ্ছে, মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্তারা, বিচারকরা যে টাকায় সচ্ছল জীবনযাপন করেন, সরকারি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে টাকা বেতন পান, আবাসন পান তাও জনগণের টাকা। জনগণের কাছেই সবার যত ঋণ।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে যারা নারকীয় হামলা চালিয়েছে ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের আটক করা হচ্ছে। এই বর্বর হামলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় শাস্তি প্রদান যেমন প্রয়োজন, তেমন যারা প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতুড়ি নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে ছাত্রদের হাড় ভেঙে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রভোস্ট কাউন্সিল ক্যাম্পাস এলাকায় পূর্বানুমতি ছাড়া বহিরাগতদের চলাফেরা নিষিদ্ধ করেছে। সাবেক ভিসি অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক এই উদ্ভট সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেছেন, প্রভোস্টরা নিজ নিজ হলের বহিরাগতদের বের করে দেওয়ার এখতিয়ার রাখলেও এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন না। ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক-স্বজনরা অনুমতি ছাড়া দেখা করতে পারবেন না, এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবসম্মত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সাবেক ছাত্র-শিক্ষকদেরও আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দলবাজ প্রশাসন যে ভূমিকা পালন করছে তাতে ভবিষ্যৎ ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে কিনা জানি না। কিন্তু এটুকু বলা যায়, সামরিক জমানায়ও এমন মেরুদণ্ডহীন প্রশাসন আমরা দেখিনি। ভুলের চোরাবালিতে ডুবলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদেরও উপলব্ধি করতে হবে, সরকার যেখানে কমিটি গঠন করে দাবি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে, সেখানে আন্দোলনে বিরতি দিয়ে উচিত অপেক্ষা ও আলোচনার পথ নেওয়া। সব মহলকেই উপলব্ধি করতে হবে, ক্যাম্পাসগুলোয় আতঙ্কগ্রস্ত এবং অস্থির ঘটনাপ্রবাহ গণতান্ত্রিক সমাজে সুখকর নয়।
এদিকে বিএনপি থেকে বার বার অভিযোগ করা হচ্ছে, তাদের কারাবন্দী দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। তারা চেয়েছেন ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে। অন্যদিকে সরকার প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে সম্মত হয়েছে। ইউনাইটেডে দিতে সরকার রাজি নয়। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই নয়, বড় দলের নেত্রী হিসেবেই নয়, একজন মানুষ হিসেবেও কারাবন্দী হলেও অসুস্থ হলে বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রয়োজন। সরকার যদি সিএমএইচে চিকিৎসা করাতে চায়, তাহলে বিএনপির আপত্তি কেন বুঝতে পারি না। হাসপাতাল ইস্যুতে রাজনৈতিক বিতর্কের চেয়ে বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ হলে তাঁর চিকিৎসাই আগে জরুরি। সিএমএইচে উন্নতমানের চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা করাতে বিএনপির অনীহা কেন?
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না হলেও রহস্য উদ্ঘাটন না ঘটলেও ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে এবার। ভোল্টেজে রাখা সোনা মিশ্র ধাতুতে পরিণত হয়েছে। হায় বাংলাদেশ ব্যাংক, যেখানে রিজার্ভের টাকার পর আমাদের সোনাও নিরাপদ নয়।
সূত্র: বাংলােদশ প্রতিদিন লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।